ক্যাপ্টেন হ্যাডকের হুইস্কি
ক্যাপ্টেন আর্চিবল্ড হ্যাডক। টিনটিনের মাতাল নাবিক বন্ধু। এমনিতে রাম, হুইস্কি বা ওয়াইন – কোনো কিছুতেই তাঁর অরুচি নেই। তবে প্রিয় পানীয় অবশ্যই হুইস্কি। আর প্রিয় ব্র্যান্ড? টিনটিনপ্রেমী কাউকে জিজ্ঞেস করা হলে সেকেন্ডের মধ্যে উত্তর চলে আসবে। লখ লোমোন্ড। হাইল্যান্ড স্কচ হুইস্কি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো বইয়ের পাতায় খুঁজতে গেলে লখ লোমোন্ডের উল্লেখ প্রায় নেই বললেই চলে। তেইশখানা সম্পূর্ণ টিনটিনে কুড়িয়ে বাড়িয়ে সাকুল্যে সোয়া দুখানায়। তার মধ্যে একটা আবার ক্যাপ্টেনের আসার আগের। তাহলে?
টিনটিনের সপ্তম বই দ্য ব্ল্যাক আইল্যান্ডে প্রথম ব্র্যান্ডের উল্ল্যেখ করতে দেখা যায় অ্যার্জেকে। ডঃ মূলার আর তার সাগরেদ ইভানকে তাড়া করতে করতে টিনটিন উঠে পড়ে একটা মালগাড়িতে। জনি ওয়াকার হুইস্কির ট্যাঙ্কারের পাশে। তার কয়েক পাতা পরেই ওয়াইট হার্ট পাবের ভিতরে জিঞ্জার বিয়ার আর জিন টনিকের পোস্টারের পাশেই দেখা যায় গিনেসের বিজ্ঞাপন। স্কটল্যান্ডের কিলটখের পাবে দেখা যায় আরেক হুইস্কির পোস্টার। জন হেগ। অবশ্য মদের পিপের বাইরে শুধু ওল্ড স্কচ হুইস্কি লেখা ছিল।
মজার ব্যাপার হলো এর দুটো বই পরে ক্যাপ্টেনের প্রথম গল্প দ্য ক্র্যাব উইথ দ্য গোল্ডেন ক্লশে কিন্তু কোনো ব্র্যান্ডের উল্ল্যেখ দেখা যায় না। বোতলের গায়ে শুধু ওল্ড হুইস্কি বা ওল্ড স্কচ হুইস্কি লেখা ছিল। ক্যাপ্টেন আসবার পর প্রথম ব্রান্ডের নাম পাওয়া যায় পরের গল্প দ্য শুটিং স্টারে। সোসাইটি অফ সোবার সেলার্স তাদের সান্মানিক প্রেসিডেন্ট হ্যাডককে বিদায় সংবর্ধনা দিতে এসে দেখে জাহাজে ক্যাপ্টেনের জন্য প্রচুর বাক্স উঠছে। আর বাক্সের বাইরে লেখা জন হেগ হুইস্কি।
জন হেগের উল্লেখ আবার পাওয়া যায় রেড সি শার্কসে। অ্যলানের হাতে বন্দী ক্যাপ্টেন আর টিনটিনের কেবিনে রাখা ছিল জন হেগ গোল্ড লেবেলের বোতল। তাহলে এই জন হেগ ছাপিয়ে লখ লোমোন্ড জুড়ে বসলো কোথা থেকে?
আমরা সবাই জানি টিনটিনের প্রথম নটা বই আদতে ছিল সাদা কালো। পাতার সংখ্যাও ছিল বেশি। পরে রং চাপিয়ে পৃষ্ঠা সংখ্যা কমিয়ে নতুন করে ছাপানো হয়। এই বইগুলো সবই ছিল মূল ফরাসিতে। ব্রিটেনে ইংরেজি অনুবাদে প্রথম টিনটিন ছাপে দ্য ঈগল ম্যাগাজিন। কিং ওটোকারস স্কেপ্টর। পরে মেথুয়েন বই হিসেবে ছাপতে শুরু করে। কিন্তু মূল ক্রম অনুযায়ী নয়। টিনটিনকে চাঁদ থেকে তিব্বত ঘুরিয়ে আনার পর ছাপা হয় দ্য ব্ল্যাক আইল্যান্ড। আর এই বইটা ছাপতে গিয়েই পালটে যায় ক্যাপ্টেনের পছন্দ।
দ্য ব্ল্যাক আইল্যান্ড গল্পের অনেকটাই যেহেতু ব্রিটেনে, মেথুয়েন তাই অ্যার্জেকে জানায় সে দেশের পাঠকদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য বইয়ের বেশ কিছু ভুল ঠিক করতে হবে। শোনা যায় ১৩১ টা ভুলের লিস্টিও নাকি ধরানো হয়েছিল। সেই অনুযায়ী আবার নতুন করে আঁকা হয় ব্ল্যাক আইল্যান্ড। আর তখনই পালটে দেওয়া হয় জনি ওয়াকার আর জন হেগের নাম। বাদ পরে গিনেস। মূলত ছোটদের বইতে আসল মদের কোম্পানির নাম রাখতে চায়নি প্রকাশকেরা। তাই নিয়ে আসা হয় কাল্পনিক লখ লোমোন্ডকে। এমনকি ওল্ড স্কচ হুইস্কি লেখা পিপেগুলোও পালটে দেওয়া হয়। ব্ল্যাক আইল্যান্ড পড়লে মনে হতেই পারে ব্রিটেনে লখ লোমোন্ড ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না।
টিনটিনের অন্য বইতে যেহেতু সেভাবে মদের ব্রান্ড উল্লেখ করা ছিল না, তাই সেগুলো নিয়ে বিশেষ অসুবিধে হয়নি। দ্য শুটিং স্টারে বাক্সের গায়ে লেখা জন হেগ হুইস্কি থেকে জন হেগ নামটা মুছে দিতে হয়েছিল শুধু। মজার ব্যাপার আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যায় রেড সি শার্কের জন হেগের বোতলটা। হয়ত পুরো নামটা দেখা যাচ্ছিল না বলেই।
নতুন করে আঁকা দ্য ব্ল্যাক আইল্যান্ড ১৯৬৫ সালে ধারাবাহিকভাবে টিনটিন ম্যাগাজিনে ছাপা হয়। পরের বছর বেরোয় বই হয়ে। এরপর টিনটিনের আর মাত্র দুটো সম্পূর্ণ বই প্রকাশিত হয়। ফ্লাইট ৭১৪ টু সিডনি আর টিনটিন অ্যান্ড দ্য পিকারোজ। দুটো বইতেই লখ লোমোন্ডের উল্লেখ থাকলেও ক্যাপ্টেনকে খেতে দেখা যায় একমাত্র পিকারোজে। মোট তেইশটা সম্পূর্ণ বইয়ে মাত্র দুবার হ্যাডককে নিজের পছন্দের হুইস্কি আনাতে বা খেতে দেখা যায়। প্রথমবার শুটিং স্টারে জন হেগ, দ্বিতীয়বার পিকারোজে লখ লোমোন্ড। জন হেগ বাদ পরে যায়, টিকে যায় লখ লোমোন্ডের নাম।
কিন্তু যেই কারণে এত বদল, আসল কোম্পানির নাম ব্যবহার না করা, সেইটা কি শেষ পর্যন্ত রক্ষা করা গেল? লখ লোমোন্ড স্কটল্যান্ডের একটা হ্রদ। অ্যার্জে হয়তো ভেবেছিলেন এই নামটা দিলে ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য হবে। কিন্তু ওঁর জানা ছিল না যে এই নামে সত্যিই একটা ডিস্টিলারি ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে মাত্র কয়েক বছর চলেছিল সেটা। মজার ব্যাপার হলো ১৯৬৫ তে, নতুন করে আঁকা দ্য ব্ল্যাক আইল্যান্ড ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের বছরেই, আবার চালু হয় লখ লোমোন্ড। মাঝের কিছু বছর বাদ দিলে এখনো রমরমিয়ে চলছে লখ লোমোন্ড হুইস্কি বানানো।
খুব ভালো লাগলো
ধন্যবাদ 🙂
খুবই ভালো লাগলো লেখাটা – উপাদেয়।
অসংখ্য ধন্যবাদ 🙂