পেরিগ্যাল রহস্য – ২
।।২।।
“রয়্যাল এক্সচেঞ্জে পেরিগ্যালদের তিন পুরুষ অবধি ব্যবসার খোঁজ পেয়েছি।”
আমরা হাঁটছি অক্সফোর্ড স্ট্রিট ধরে। টিউবে আওয়াজের জন্য এতক্ষন চুপ ছিল ফেলুদা। রাস্তায় উঠে আবার বলতে শুরু করেছে।
“মজার ব্যাপার হল বাবা, ছেলে, নাতি, তিনজনেরই নাম এক।”
“বলেন কি মশাই। তিন পুরুষের ব্যবসা, পুরোটাই ফ্রানসিস পেরিগাল!”
“ইয়েস স্যার।”, ফেলুদা ডানদিকের রাস্তায় ঢুকতে ঢুকতে বলল, “যদিও সেটা খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এখানের রাজাদের কথাই ধরুন না। হেনরির ছেলে হেনরি, জর্জের ছেলে জর্জ।”
আমি এরমধ্যে রোড সাইন থেকে দেখে নিয়েছি রাস্তাটার নাম নিউ বন্ড স্ট্রিট। অক্সফোর্ড স্ট্রিটের থেকে সরু হলেও দুদিকে বড় বড় ঝা চকচকে দোকানে ভর্তি।
“ভাববার বিষয় যেটা, সেটা হল এই তিনজন ছাড়াও আরেক ফ্রানসিস পেরিগাল ওই সময়, এই লন্ডনের বুকেই ঘড়ির ব্যবসা চালাচ্ছিল। এ হল রয়াল এক্সচেঞ্জের বড় ফ্রানসিসের ভাইপো। ওঁর কাছেই ঘড়ির কাজ শিখে এই নিউ বন্ড স্ট্রীটে নিজের ব্যবসা খোলে।”
আমরা এসে দাঁড়িয়েছি একটা চারমাথার মোড়ে। রাস্তার ওপারে বাঁদিকে একটা পুরনো দিনের বিশাল বাড়ি। গায়ে বড় করে লেখা ফেনিক। সেদিকে তাকিয়ে ফেলুদা বললো, “১৮৯১ সাল থেকে এই ডিপার্টমেন্ট স্টোরটা আছে এখানে। তার আগে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এই বাড়িটারই একটা অংশে ছিল ভাইপো ফ্র্যান্সিসের দোকান। রয়াল এক্সচেঞ্জের পেরিগ্যালদের থেকে কিন্তু কোন অংশে কম ছিলেন না ইনি।”
“বোঝো কান্ড! তাহলে আমাদের পেরিগ্যালটা কাদের বানানো বুঝবো কী করে?”, লালমোহনবাবুর গলায় হতাশার সুর স্পষ্ট।
“পুরোপুরি নিশ্চিতভাবে বলা বোধহয় সম্ভব নয়। বিভিন্ন তথ্য থেকে বড়জোর অনুমান করা যেতে পারে।”
“আচ্ছা ফেলুদা, এদের মধ্যে কেউ ভারতে ঘড়ি পাঠাতো কিনা জানা যায় না?”
“ভেরি গুড তোপসে। ভারতে না হলেও, মার্কউইক মার্খ্যাম নামে একটা কোম্পানি একসময় টার্কির জন্য ঘড়ি পাঠাতো লন্ডন থেকে। এখানের বিভিন্ন বড় ঘড়ি নির্মাতাদের সঙ্গে পার্টনারশিপে। তার মধ্যে ছিল পেরিগ্যালও। এবং সেটা, যতদূর জানা যায়, রয়্যাল এক্সচেঞ্জের ফ্র্যান্সিস পেরিগ্যাল। টার্কিশ বাজার থেকে সেই ঘড়ির আওয়াধ পৌঁছনোর সম্ভাবনা কিন্তু একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”
“তাহলে রয়্যাল এক্সচেঞ্জ থেকেই আওয়াধের রয়্যাল কোর্ট?” – লালমোহনবাবু একগাল হেসে বললেন। ভদ্রলোক রয়্যাল এক্সচেঞ্জের জাঁকজমক থেকে বেরোতে পারেননি বোঝাই যাচ্ছে।
“ধীরে লালমোহনবাবু, ধীরে। এই মার্কউইক মার্খ্যামের ঘড়ির দুটো বৈশিষ্ট্য ছিল। এক, পেরিগ্যালের সঙ্গে ঘড়িতে ওঁদের নামও থাকত। আর দুই, ঘড়ির ডায়ালে ব্যবহার করা হত টার্কিশ সংখ্যা। এগুলোর কোনটাই কিন্তু আমাদের দেখা পেরিগ্যালে ছিল না।”
“যাঃ। এতো স্কোয়ার ব্যাক হয়ে গেল।”
ভদ্রলোক নির্ঘাৎ ‘ব্যাক টু স্কোয়ার ওয়ান’ বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফেলুদা সেদিকে কান না দিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে বললো, “এই মার্কউইক মার্খ্যাম আর টার্কিশ মার্কেট নিয়ে পড়তে গিয়ে একটা মজাদার জিনিস পেলাম। সে সময় আমাদের দেশে ইংল্যান্ডের যেই ঘড়িগুলো আসত, তার অনেকগুলোই ছিল আদতে সুইস। বিশেষজ্ঞদের মতে যা অপেক্ষাকৃত নিচু মানের। ভেবে দেখুন লালমোহনবাবু, অষ্টাদশ শতাব্দীর সুইস রিপাব্লিক ছিল ঘড়ি ব্যবসায় যাকে বলে আজকের দিনের চিন।”
“ভাবা যায়! আর আজ কিনা তাদেরই রমরমা!”
“ইয়েস স্যার। তবে কিনা তার পিছনে কারণও আছে অনেক। সে সব না হয় আরেকদিন বলা যাবে। আপাতত, আমাদের পেরিগ্যাল কে ছিল সেটা খোঁজার চেষ্টা করা যাক বরং।”
“আচ্ছা, নবাব যখন, তখন নিশ্চয়ই একটা ইয়ে দেখেই কিনবেন, তাই না ফেলুবাবু? আমার ত প্রথম থেকেই মনে হচ্ছে ওই ঘড়ি রয়্যাল এক্সচেঞ্জ ছাড়া হতেই পারে না।”
“ঘড়িটা কিন্তু তিনি কোম্পানির কাছ থেকে ভেট হিসেবেও পেয়ে থাকতেই পারেন, লালমোহনবাবু। তবে, আপনার যুক্তিটার সাথে আমি একদম একমত। নবাব নিজেই কিনুন, বা কোম্পানি তাকে দিক, সেই সময়ে যাদের নাম বেশি ছিল, ঘড়িটা তাদের হওয়ার সম্ভাবনাই যে বেশি, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।”
একটু থেমে, বোধহয় একটু গুছিয়ে নিয়ে, ফেলুদা আবার শুরু করলো। “রয়্যাল এক্সচেঞ্জের পেরিগ্যালদের কৌলিন্য নিয়ে কোন সন্দেহই নেই। তিন পুরুষের ব্যবসা। তার উপর লন্ডন আর তার আশপাশের এলাকার ঘড়ি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতো যেই Worshipful Company of Clockmakers, এদের তিন প্রজন্মই সেখানের মাস্টার বা সবথেকে উঁচু পদে ছিলো।
তবে নিউ বন্ড স্ট্রীটের ফ্র্যান্সিসকেও কিন্তু হেলাফেলা করা উচিত না। আগেই বলেছি রয়্যাল এক্সচেঞ্জের পেরিগ্যালদের থেকে কোন অংশে কম ছিলেন না ইনি। কিন্তু ভালো ঘড়ি বানানো ছাড়াও এঁর কাছে এমন একটা জিনিস ছিলো, যেটা ওই পেরিগ্যালদের তিন পুরুষের কারোর ভাগ্যেই জোটেনি।”
“কী?”, আমি আর লালমোহনবাবু একসাথে বলে উঠি।
“রয়্যাল ওয়ারান্ট।”
“ওয়ারান্ট! মানে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো?”
“না লালমোহনবাবু, রয়্যাল ওয়ারান্ট মানে রাজার নাম ব্যবহার করার অনুমতি। খাতায় কলমে “Watchmaker to his Majesty”। ১৭৮৪ সালে বন্ড স্ট্রীটের ফ্রানসিস পেরিগ্যালকে দেওয়া হয় এটা। ওদিকে আমাদের সাদাত আলি নবাব হন ১৭৯৮ সালে। এবার আপনিই ভেবে দেখুন কোম্পানির দয়ায় রাজত্ব পাওয়া নবাবের কাছে এটার ব্র্যান্ড ভ্যালু কতটা হতে পারে! সুতরাং, নিশ্চিত ভাবে বলা না গেলেও, সব তথ্য অনুযায়ী, আমরা যেই ঘড়িটা দেখেছিলাম, সেটা এঁর বানানো হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।“
লালমোহনবাবু মুগ্ধ চোখে ফেনিকের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এবার চাপা গলায় ধীরে ধীরে বলে উঠলেন, “ওয়াচমেকার টু হিস মাজেস্টিক-টিক-টিক-টিক-টিক-টিক-টিক-টিক।”
অলংকরণ: সৈকত সুরাই