বিনা প্ল্যানে, ফ্রিডরিকসহাফেনে – ২

আমাদের ওয়াইনগার্টন যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল সেন্ট মার্টিন ব্যাসিলিকা দেখা। জার্মানির দ্বিতীয় বৃহত্তম চার্চ। দেশের বৃহত্তম ব্যারক চার্চ। বছর দুয়েক আগে মিউনিখ ঘুরতে গিয়ে আশাম ভাইদের পারিবারিক চার্চ দেখে খুব ভালো লেগেছিলো। এই সেন্ট মার্টিন ব্যাসিলিকার কাজও এই দুই ভাইয়েরই করা। এছাড়াও ওয়াইনগার্টন জায়গাটাও বেশ সুন্দর। স্টেশন থেকে চার্চ পৌনে তিন কিলোমিটার মতন। সুন্দর একটা ছোট্ট হাঁটাও হয়ে যাবে। 

ট্রেন চলে এল একটু পরেই। দু-কামরার ছোট ট্রেন। প্রায় পুরোটাই ফাঁকা। বিশাল বিশাল জানলার ধারে মুখোমুখি দুটো সিট বাগিয়ে বসে পড়লাম আয়েস করে। সবুজ মাঠ, ক্ষেত, মাঝে মাঝে জনপদ। যাত্রী, আমরা ছাড়া, সবাই মনে হল স্থানীয়ই। দু একজনকে দেখে বোঝা যাচ্ছে বাজার করে ফিরছে।

ওয়াইনগার্টন বেয়াখ স্টেশন
ওয়াইনগার্টন বেয়াখ স্টেশন

আমরা নামলাম ওয়াইনগার্টন বেয়াখ। স্টেশনের পূর্ব দিকে ওয়াইনগার্টন আর পশ্চিমে বেয়াখ অঞ্চল (বানান Berg, জার্মান মানে পাহাড়)। এয়ারপোর্ট থেকে লাগলো আঠেরো মিনিট। ট্রেন আমাদের নামিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখি দুই পাশে ফাঁকা মাঠ। স্টেশনের গায়েই অবশ্য বাস স্টপ। একটা বাস দাঁড়িয়েও ছিল। তবে আমরা পূর্ব পরিকল্পনা ত্যাগ না করে নেমে পড়লাম রাস্তায়। 

ওয়াইনগার্টন যাওয়ার বাস
ওয়াইনগার্টন যাওয়ার বাস

শীতের সকাল। আকাশ মেঘলা হলেও বৃষ্টি পড়ছে না। দুপাশে সবুজ মাঠ। আরামদায়ক চওড়া ফুটপাথ। আর কী চাই? দূরে ওয়াইনগার্টেনের বাড়িগুলো দেখা যাচ্ছে। তাড়াও নেই বিশেষ। হেলে দুলে, ছবি তুলতে তুলতে হাঁটা মারলাম। 

ওয়াইনগার্টেনের পথে
ওয়াইনগার্টেনের পথে

মাঠ পেরিয়ে বাড়ি ঘর শুরু হল। কিছু আধুনিক ফ্ল্যাট, কিছু বাংলো। একটা বাড়ীতে দূর থেকেই নজরে পড়লো দেওয়ালে পাখি আর রামধনু আঁকা। সামনের জানলাতেও রামধনু পতাকা। উপরে লেখা PACE. বুঝলাম পাখিটা পায়রা। এই PACE লেখা রামধনু পতাকার উৎপত্তি ইতালিতে ১৯৬১ সালে। ওদের ভাষায় শান্তি বা peace হলো pace. শান্তির পতাকা। এই পতাকার পুরনো একটা সংস্করণে শান্তির প্রতীক পায়রা এঁকেছিলেন স্বয়ং পিকাসো। ২০০২ সালে Pace da tutti i balconi (প্রত্যেক ব্যালকনি থেকে শান্তি) ক্যাম্পেনের মাধ্যমে এই পতাকা জনপ্রিয়তা লাভ করে। 

পিস ফ্ল্যাগের বাড়ি
পিস ফ্ল্যাগের বাড়ি

তবে বাড়িটার মজা এখানেই শেষ নয়। বাগানে কয়েকটা রডের উপর উঁচুতে বসানো একটা আস্ত ফোক্সওয়াগন বিটল। গায়ে শনি আর মঙ্গলগ্রহের ছবি। নিচে লেখা Save our planet. নিচে রডে লেখা নাম গুগলে খুঁজে যা পেলাম তা হোল স্থানীয় একটি গাড়ি সারানোর কোম্পানির পুরনো বিটল গাড়িতে বিভিন্ন রকম ছবি আঁকার এক প্রজেক্টের অংশ এটা। 

দুটো সুপার মার্কেট পেরিয়ে এলাম। Aldi আর Lidl। দুটোই জার্মান কোম্পানি। তবে সারা বিশ্বের প্রচুর দেশে ছড়িয়ে আছে এরা। আশেপাশে সুন্দর সুন্দর বাড়ি দেখতে দেখতে হাঁটছিলাম আমরা। সব থেকে ভালো লাগছিলো জানলাগুলো। আধুনিক শার্সি দেওয়া জানলা। কিন্তু সাথে পুরনো দিনের মতন কাঠের কপাট। কপাটগুলো খুলে বাইরের দেওয়ালে লাগানো হুকে আটকানো। ওইরকমই থাকে সব সময়। পুরোটাই সাজানোর জন্য। ইউরোপের বেশ কিছু দেশে এরকম জানলাওয়ালা প্রচুর বাড়ি দেখা যায়। দক্ষিন জার্মানিতেও এই রীতি বেশ জনপ্রিয়।

কপাট খোলা জানলা
কপাট খোলা জানলা
মনাস্টিক কালচারের মিউজিয়াম
মনাস্টিক কালচারের মিউজিয়াম

চার্চের কাছাকাছি এসে চোখে পড়ল একটা মিউজিয়াম। মনাস্টিক কালচারের। এই বাড়িটায় জানলা দরজার ধার দিয়ে দেওয়ালে রঙ করা। মানে কারুকার্য যা হতে পারত, সেটাই এঁকে দিয়েছে। ফেরবার সময়ে এরকম আরো কিছু বাড়ি চোখে পড়েছিল। দেওয়ালে ম্যুরালও দেখলাম কয়েকটা বাড়িতে। 

জানলার চারদিকে নকশা আর দেওয়ালে ম্যুরাল
জানলার চারদিকে নকশা আর দেওয়ালে ম্যুরাল

১০৫৬ সালে যখন ওয়াইনগার্টেন অ্যাবি প্রতিষ্ঠা করা হয় তখন এখানে আল্টডর্ফ নামে একটা ছোট গ্রাম ছিল। পরে অ্যাবির নামে জায়গাটারও নাম হয়ে যায় ওয়াইনগার্টেন। এখনকার চার্চটা বানানো শেষ হয় ১৭২৪ সালে। অ্যাবি এখন আর নেই। চার্চের আশেপাশের বাড়ি বিভিন্ন অন্য কাজে ব্যবহার করা হয়। 

সেন্ট মার্টিন ব্যাসিলিকা
সেন্ট মার্টিন ব্যাসিলিকা

আমরা যখন ভিতরে ঢুকলাম, বিশাল চার্চ তখন একদম ফাঁকা। মিউনিখের আশাম চার্চের মতন ভর্তি কাজ এখানে নেই। তবে যা আছে মন ভরানোর জন্য যথেষ্ট। গম্বুজে এমন ভাবে আঁকা, দেখে মনে হয় উপরে ছাদ নেই। খোলা। আর সেই ফাঁক দিয়ে উপরের আরো একটা তলা দেখা যাচ্ছে। গম্বুজের ধার দিয়ে স্টাকোর কাজ। ছাদের আঁকা কিছু জায়গায় তার ভিতর ঢুকে আসায় একটা ত্রিমাত্রিক ব্যাপার তৈরি হয়েছে। দেওয়ালের কিছু ফ্রেস্কোও এমনভাবে আঁকা আচমকা দেখলে মনে হবে মূর্তি। তার আশেপাশে আবার সত্যি কিছু মূর্তি থাকায় ভুলটা আরো বেশি হয়। 

গম্বুজের আঁকা
গম্বুজের আঁকা
দেওয়ালের ফ্রেসকো
দেওয়ালের ফ্রেসকো এবং মূর্তি

আমরা তো এসেছি চার্চের কাজ দেখতে। কিন্তু ধর্মীয় কারনেও সেন্ট মার্টিন খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই চার্চেই নাকি রাখা আছে যীশুর রক্ত। বছরে একদিন তা নিয়ে বেরোয় মিছিল। তাতে অংশ নেয় দুই থেকে তিন হাজার ঘোড়সওয়ার। সে এক এলাহি ব্যাপার!

জোসেপ গ্যাবলারের অরগ্যান
জোসেপ গ্যাবলারের অরগ্যান

এখানের আরেকটা বিখ্যাত জিনিষ হোলো চার্চের অর্গানটা। জোসেপ গ্যাবলার, যিনি এই অর্গান বানান, তাঁকে সেটা এমনভাবে বানাতে হয়েছিলো যাতে পিছনের ছটা জানলা ঢেকে না যায়। তার জন্য বেশ কসরত করে নতুন কিছু পরিকল্পনা তাঁকে করতে হয়। এই অর্গান আর জোসেপকে নিয়ে প্রচুর গল্প চালু আছে এখানে। তার একটা হল কাজ শেষ হওয়ার পর টাকাপয়াসার ব্যাপারে গড়িমসি করতে থাকেন অ্যাবির সন্ন্যাসীরা। জোসেপ একদিন ভালোমানুষের মতন অর্গানের চাবি চান কিছু একটা ঠিক আছে কিনা দেখবেন বলে। দেখবার সময় ভিতরের কোনো একটা লিভার উনি সরিয়ে দেন। তাতেই নাকি ফাটা বাঁশের মতন আওয়াজ বেরোতে থাকে অর্গান থেকে। বাধ্য হয়ে বকেয়া টাকা মিটিয়ে দিতে হয় অ্যাবিকে। জোসেপও আবার ঠিক করে দেয় অর্গান। ওই একটি মাত্র লিভার ঠিক জায়গায় বসিয়ে।

ওয়াইনগার্টেনের রাস্তায়
ওয়াইনগার্টেনের রাস্তায়

চার্চ থেকে বেরিয়ে আশপাশটা উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরছিলাম। ছবির মতন বাড়ি, ফাঁকা রাস্তাঘাট, সাজানো ক্রিসমাস ট্রি। এরই মধ্যে চোখে পড়লো একটা মূর্তি। একজন মহিলা, হাঁটু গেঁড়ে বসে, সঙ্গে একটা বাচ্চা। হাত বাড়িয়ে ভিক্ষা চাইছে। সামনে চেয়ারে বসে আরেক মহিলা। অন্য দিকে তাকিয়ে আছেন। মাথায় মুকুট দেখে বোঝা যাচ্ছে শাসকস্থানীয় কেউ। আবার গুগলজেঠুর শরণাপন্ন হোতে হল। 

ওয়েফ মূর্তি
ওয়েফ মূর্তি

ওয়াইনগার্টেন অ্যাবি প্রতিষ্ঠা করেন ওয়েফ প্রথম। এই ওয়েফ বংশ শুধু জার্মানি নয় বহুদিন ব্রিটেনও শাসন করে। শুরু হয় ১৭১৪ সালে জর্জ প্রথমকে দিয়ে। শেষ হয় রাণী ভিক্টোরিয়াকে দিয়ে ১৯০১ সালে। তা এই ওয়েফ বংশের শুরু নিয়ে আছে নানা কাহিনী। তার মধ্যে সবথেকে প্রচলিত যেটা, সেটা এরকম – 

বহুকাল আগে এই অঞ্চলের রাজার স্ত্রী ছিলেন খুবই নির্মম ও লোভী। একবার এক বিধবা মহিলা ভিক্ষা চাইতে এলে উনি এতটাই খারাপ ব্যবহার করেন যে মহিলা ওঁকে শাপ দেন। কদিন পরে রানী একসাথে বারোটি ছেলের জন্ম দেন। মুশকিল হল সেই সময় একসাথে একাধিক বাচ্চার জন্ম খুবই খারাপ চোখে দেখা হোত। বলা হতো যতজন সন্তান ততজন বাবা। রানী তাই এক পরিচারিকাকে বলেন একটি রেখে বাকি এগারটি বাচ্চাকে জলে ভাসিয়ে দিতে। থলে করে বাচ্চাগুলোকে নিয়ে যাবার সময় রাজা পরিচারিকাকে ধরে ফেলেন। প্রথমে রাজার হাত থেকে বাঁচতে পরিচারিকা বলেন এগুলো কুকুরের বাচ্চা। আওয়াজে রানীর অসুবিধা হচ্ছে বলে এদের ফেলে আসতে বলা হয়েছে। রাজার বিশ্বাস না হওয়ায় থলে খুলতে বলা হয় এবং আসল ব্যাপার ধরা পড়ে। রাজা রানীকে না জানিয়ে এক মিল মালিকের কাছে তাদের রেখে আসেন। 

ছেলেরা বড় হলে রাজা সভা ডেকে সবার সামনে সত্য উন্মোচন করেন। রানীর দোষের শাস্তি দেন মৃত্যুদন্ড। তবে শেষ পর্যন্ত ছেলেদের অনুরোধে বেঁচে যান রানী। আর তখন থেকেই এই এগারো ভাইয়ের নাম হয়ে যায় ওয়েফ। পুরনো জার্মানে যার মানে বাচ্চা কুকুর। 

[ক্রমশ]