বিনা প্ল্যানে, ফ্রিডরিকসহাফেনে – ১
বাঙালি নাকি ঘুরতে যাওয়ার থেকেও ঘোরার পরিকল্পনা করতে ভালবাসে বেশি। কোথাও থেকে ঘুরে ফিরতে না ফিরতেই শুরু হয়ে যায় পরেরবারের খোঁজখবর। সত্যি মিথ্যে জানা নেই, তবে আমিও অনেকটা ওইরকমই। সারা বছরই মনটা উড়ু-উড়ু। ভ্রমণকাহিনী আর ট্রাভেল ব্লগ পড়তে পড়তে সেইসব জায়গা নিয়ে ঘাটাঘাটিও শুরু করে দিই নিজের অজান্তেই। তবুও সব ঘোরা কি আর পরিকল্পনা মাফিক হয়?
২০১৯ এর ডিসেম্বরে ইচ্ছে ছিল পূর্বতন যুগোস্লাভিয়ার কিছু দেশে ঘুরতে যাওয়ার। কিন্তু কবে থেকে ছুটি পাওয়া যাবে জানতে জানতে এত দেরি হয়ে গেল, যে দেখা গেল প্লেনের টিকেট চলে গেছে ধরা ছোওয়ার বাইরে। একদম হাল ছেড়ে দেওয়ার আগে শেষ চেষ্টা হিসেবে দেখছিলাম আশেপাশের কোনো জায়গায় সস্তায় কিছু পাওয়া যায় কিনা। শেষ পর্যন্ত, খুব কাছে না হলেও, খোঁজ পেলাম ছোট জার্মান শহর ফ্রিডরিকসহাফেনের। প্লেন, বাস আর ট্রেন মিলিয়ে ফ্রিডরিকসহাফেন হয়ে স্লোভেনিয়া ঢুকতে যা লাগবে সেটাও সরাসরি প্লেন ভাড়ার থেকে অনেকটাই কম। মাঝে উপরি পাওনা লিকটেনস্টাইন।
আমাদের বাজেট এয়ারলাইন্সের চাকা যখন ফ্রিডরিকসহাফেনের পুঁচকে বিমানবন্দরের মাটি ছুঁল, স্থানীয় সময় তখন সকাল সাড়ে সাতটা। নামবার সময় দেখি একজন সিঁড়ির সামনেই এক থালা লজেন্স নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার পিছনেই একজন মহিলা বিশাল একটা সান্তা ক্লজ পুতুল নিয়ে হাত নাড়িয়ে চলেছে। ক্রিসমাস স্পেশাল অভ্যর্থনা মনে হয়।
ফ্রিডরিকসহাফেন বিমানবন্দর একদমই ছোট। ইমিগ্রেশনও হয়ে গেল ঝটপট। তবে ভারতীয় পাসপোর্ট দেখে কিনা জানিনা, মামুলি প্রশ্ন করলো প্রচুর। কতদিনের প্লান, স্কি করতে এসেছি কিনা, আর কোন দেশে যাব, এইসব। ওদিকে বেড়িয়ে দেখি ব্যাটা পাসপোর্টে স্ট্যাম্পই মারেনি। এমনিতে আজকাল প্রচুর দেশই আর স্ট্যাম্প মারেনা। স্ক্যান করলেই হয়। কিন্তু আমাদের তালিকায় এবার এমন দুটো দেশ আছে যারা ইউরোপিয় ইউনিয়নের অন্তর্গত নয়। বসনিয়া ও হারজেগোভিনা আর সারবিয়া। এমনিতে সেঙ্গেন ভিসা থাকলেই ঢোকা যায় দেশগুলোতে। কিন্তু প্রথমে যে কোনো একটা সেঙ্গেন দেশ হয়ে ঢুকতে হবে। প্লেন হলে চিন্তা ছিল না। কিন্তু আমরা দুটো দেশেই ঢুকবো বাসে চেপে। এই বর্ডারগুলোয় অনেক সময়েই এয়ারপোর্টের মত অত সুবিধা থাকে না। সাবধানের মার নেই। সুতরাং আবার ফিরে চললাম ইমিগ্রেশন কাউন্টারের দিকে।
এদিকে ততক্ষনে ইমিগ্রেশন হয়ে গেছে সবার। আমাদেরটাই সকালের একমাত্র প্লেন ছিলো। ভাগ্য ভালো একদম বেড়িয়ে যাবার মুখে পেয়ে গেলাম দুই মহিলা অফিসারকে। সব খুলে বলতে বলল, স্ট্যাম্প তো মারা উচিত ছিলো আমাদের। চিন্তা কোরোনা, আমি করে দিচ্ছি। আবার ফিরলাম কাউন্টারে। দমাস দমাস পরলো দুটো স্ট্যাম্প। নিশ্চিন্ত হয়ে বেরিয়ে এলাম এবার।
আগেই বলেছি ফ্রিডরিকসহাফেন বিমানবন্দর একদমই ছোট। সাকুল্যে একটাই ক্যাফে চোখে পড়ল। তাও গলাকাটা দাম। আমাদের অবশ্য শুকনো খাবার সঙ্গেই ছিল। বাইরে বেরিয়ে রাস্তার উল্টোদিকেই ট্রেন স্টেশন। ট্রেন থামে এখানে, সেই দিক থেকে স্টেশনই বটে। তবে আলাদা কোন ব্যবস্থা নেই। একটা মেসিন আছে, নিজেই টিকিট কেটে নেওয়ার জন্য। আর ট্রেনে ওঠবার আগে সেই টিকিট ভ্যালিডেট করে নিতে হয়, আরেকটা মেসিনে ঢুকিয়ে। ভ্যালিডেট করলে যাত্রা শুরুর সময় ছেপে দেওয়া হয় টিকিটে।
শহর যেতে ধরতে হবে পশ্চিমমুখো ট্রেন। কিন্তু আমরা ফুটব্রিজ পেরিয়ে উল্টোদিকের প্ল্যাটফর্মে চলে এলাম। নাহয় টাকা বাঁচাতেই এখানে এক রাত কাটানো। তা বলে কি আর যেটুকু সময় আছে, আশপাশটা একটু ঘুরে দেখব না? এমনিতে ফ্রিডরিকসহাফেনে দেখার জিনিষ কম নেই। এয়ারপোর্টের পাশেই আছে উড়ান ও মহাকাশ বিষয়ক ডোর্নিয়ে মিউজিয়াম। একাধিক আসল বিমান ছাড়াও এখানে দেখা যায় মহাকাশ বিষয়ক মডেল। আছে শহরের মধ্যে জেপ্লিন আর স্কুল মিউজিয়াম। তবে সময় কম থাকায় আমাদের বাদ দিতে হয়েছিল মিউজিয়ামগুলোকে। তার বদলে আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল শহর থেকে একটু দূরের ওয়াইনগার্টন।