বাঙালির বিলেত ভ্রমণ – ১ (গোড়ার কথা)



ছোটবেলা থেকে বিলেত যাওয়ার শখ থাকলেও কোনদিন ভাবিনি তা কখনো সত্যি হয়ে উঠতে পারে তার উপর ঝটিতি সফর নয় গিয়ে রীতিমতো বেশ কয়েকদিন থাকা স্বাভাবিক ভাবেই প্রথমে খুব একটা আশা রাখিনি তার উপর মাত্র কয়েকমাস আগের কানাডা যাবার ভিসার আবেদন খারিজ হওয়ার কথা যখন ইউকের ভিসার আবেদনপত্রে লিখছিলাম, ভিতর থেকে কে একটা যেন বলেই চলছিলো – “হয়ে গেলো এসব দেখার পর আর দিয়েছে!

 
তবে, কথায় আছে না, প্রত্যেক সফল পুরুষের পিছনে অন্তত একজন নারীর অবদান থাকে? এযাত্রা আমার ভিসাকে পিছন থেকে গুঁতিয়ে উৎরে দিল আমার বউয়ের ভিসা তিনি ইতিমধ্যেই বিলেতে বসে চাকরী করার দরুন আমার নির্ভরশীল ভিসাকে আর খোঁচাল না ওরা খোঁচাল না ভালো, কিন্তু দিয়েও দিল একটু বেশিই তাড়াতাড়ি ভেবেছিলাম পেতে পেতে নভেম্বর হয়ে যাবে সেই অনুযায়ী কিছু কাজ সেরে মাসের শেষের দিকে রওনা হবো কিন্তু অনুমতি চলে এলো অক্টোবরের শেষেই নিয়ম হল একমাসের মধ্যে ওদেশে গিয়ে হাজিরা দিয়ে থাকার পারমিট সংগ্রহ করতে হবে আর তার শেষ দিন হল যেদিন যাবো ঠিক হয়েছে, তার পরের দিনই
 
একেই দুশ্চিন্তা করা আমার বাজে একটা স্বভাব তার উপর এই যদি প্লেন ক্যান্সেল হয়, যদি মুম্বাইতে পরের প্লেন ধরতে না পারি! এইসব উটকো চিন্তা চলতেই থাকলো মাথায় বউ ওদিকে সারাক্ষণ অভয়বাণী দিয়ে চলেছে তবে হাজার আষ্টেক কিলোমিটার দূর থেকে দিলে যা হয় আরকি
 
দিন এগিয়ে আসছে, আর ওদিকে আমি ইন্টারনেটে আমার প্লেনের নম্বর দিয়ে রোজ দেখে চলেছি ক্যান্সেল বা দেরী করছে কিনা ১০১৫ মিনিটের বেশি দেরি হচ্ছে না দেখে আস্তে আস্তে মনের জোড় বাড়ছে যাবার আগে শেষ কাজ ছিল তিনদিন ধরে পুরুলিয়া চষে সব পুরনো মন্দিরের ছবি তোলা ব্যাগপত্র মোটামুটি গুছিয়ে রেখে দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম তাল কাটল তারপরেই ১০১৫ মিনিট আস্তে আস্তে ঘণ্টাকে ছুতে আরম্ভ করলো মধ্যে একদিন লন্ডনের প্লেন মুম্বাই ছাড়ার ঘণ্টা খানেক বাদে নামলো কলকাতার বিমান তবে চিন্তা বেশী বেড়ে গেলে যা হয় আরকি ধুত্তোর, যা হবে দেখা যাবে, বলে পাশ ফিরলাম
 
শেষ পর্যন্ত সব দুশ্চিন্তাকে সপাটে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে কলকাতা এবং মুম্বাই, দুই জায়গা থেকেই প্লেন মোটামুটি ঠিক সময়েই ছাড়ল প্লেনের ঘুপচি শৌচালয় যাতে ব্যবহার না করতে হয়, তাই সিকিউরিটি চেক এর পরেই হালকা হয়ে নেওয়া আমার বরাবরের অভ্যাস এবারেও তার অন্যথা হয়নি তবে প্রায় সারে ঘণ্টা এড়িয়ে থাকতে পারব কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ ছিল খাওয়াদাওয়া, কিছুটা ঘুম আর কিছুক্ষণ খাপছাড়া ভাবে সিনেমা দেখতে দেখতেই দেখি প্লেন ইংলিশ চ্যানেলের মাঝামাঝি বিমান সেবিকা ল্যান্ডিং কার্ড বিলোতে চলে এসেছে যারা ব্রিটিশ নাগরিক নন, তাদের সবাইকেই এটা ভরতে হয় নাম ধাম, পাসপোর্ট নম্বর, কোথা থেকে আসছি, প্লেনের নম্বর এরকম কিছু গতানুগতিক তথ্য প্লেনে বসে ভরে রাখলে সুবিধে
 
আমার আসন আইলের দিকে পা ছড়ানোর সুবিধার জন্য জানালার ধারে বসি না কিন্তু বিমান এবার নামতে শুরু করেছে মাঝে মাঝে যখন আমাদের দিকে হেলছে নিচে প্রচুর আলো দেখতে পাচ্ছি সকাল হচ্ছে এখন এখানে আস্তে আস্তে প্রচুর গাড়ী, রাস্তা, বাড়ি, সবই স্পষ্ট হতে থাকল আর তারপরই জানালার পাশে চলে এলো মসৃণ একটা রাস্তা শরীর ঝাঁকিয়ে ছুঁয়ে ফেললাম হিথরোর রানওয়ে ভেসে উঠল পাইলটের গলা লন্ডনে সবাইকে স্বাগতম জানাবার সাথে সাথে বলে দিলেন বাইরের তাপমাত্রা এখন
 
বেশ কিছুটা হেঁটে ইউকে বর্ডার কন্ট্রোলে পৌঁছে দেখি বেশ ভিড় একদিকে ব্রিটিশ অন্যান্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্গত দেশগুলির নাগরিকরা, অন্যদিকে আমাদের মতন বাকিরা সাপের মতন লাইন ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে কিছু দূরে দূরে নোটিশ বোর্ড পাসপোর্ট, ল্যান্ডিং কার্ড সব হাতে রাখার নির্দেশ ফুটে উঠছে তাতে প্রথম চমকটা খেলাম যখন দেখলাম তাতে বাংলাতেও লেখা এবং নির্ভুল ভাষা বানানে মনটা খারাপও হয়ে গেলো আমার নিজের শহরটাই এখন অবোধ্য ভাষা আর বিটকেল বানানে ভরে গেছে
 
দেখতে দেখতে চলে এলো আমার পালা যদিও এটা আমেরিকা নয়, তবুও কড়া কিছু শুনতে হতে পারে ধরে নিয়েই পাসপোর্ট আর ল্যান্ডিং কার্ডটা এগিয়ে দিলাম কাঁচের ওপারের বয়স্ক মোটাসোটা ভদ্রলোক ওগুলো নিয়ে হেসে বলল, গুড মর্নিং শুকনো হেসে আমিও সম্ভাষণ জানালাম ভিসার পাতাটা বের করেই বলল – “তোমার তো আরও কিছু কাগজ থাকার কথা?” (না, বাংলায় বলেনি তাহলে ওখানেই ভির্মি খেতাম)
 
হাতে বের করাই ছিল, বলামাত্রই কাগজগুলো হস্তান্তর করলাম দেখে নিয়ে সটান আমার দিকে তাকিয়ে বলল – “তোমাকে একটা কাজ করতে হবে
 
এইরে, আবার কি চায়? ঠোটটা একবার চেটে নিয়ে বললাম – “ইয়েস
 
স্ট্যাম্প মেরে তোমাকে পাসপোর্ট ফেরত দেবার সঙ্গে সঙ্গে তুমি বাইরে যাবে, এবং একটুও সময় নষ্ট না করে যে পোস্ট অফিস থেকে তোমাকে পারমিট সংগ্রহ করতে হবে তার উদ্দেশ্যে রওনা দেবে
 
মানে, আমিও তো তাইই করতাম এরকম গোপন অভিযানে পাঠানোর মতন করে বলার মানে কি! একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উত্তর দিলাম – “হ্যাঁ।
 
দেখো তোমাকে কালকের মধ্যেই এটা নিতে হবে তবে আমি বলব কালকের জন্য অপেক্ষা কর না কালকের পরে ওটা পোস্ট অফিস থেকে আমাদের কাছে চলে আসবে তখন আমাদের কাছ থেকে ওটা সংগ্রহ করা কিন্তু বেশ ঝামেলার হবে ঠিক আছে?”
 
এক মুখ হেসে বললাম – “নিশ্চয়ই।
 
ভদ্রলোক দমাস করে স্ট্যাম্প মেরে পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে হেসে বলল – “এঞ্জয় ইওর স্টে
 
আমি ধন্যবাদ জানিয়ে বেড়িয়ে এলাম ব্রিটিশ অতি ভদ্রতা, যা আগামী কয়েক মাসে অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যাবে, এটা তার শুরু ছিল
 
ব্যাগ সংগ্রহ করে বাইরে বেরিয়ে এলাম এদের বিমানবন্দরের নিয়ম আমাদের আগে যেরকম ছিল সেরকম মানে যাত্রী ছাড়াও অন্যরা ভিতরে ঢুকতে পারে সিকিউরিটি চেকের আগে অবধি কোথায় যেতে হলে কোনদিক দিয়ে বেরোতে হবে, সব লেখা আছে লন্ডন শহরে যেতে হলে এখান থেকেই টিউব ধরা যায় তবে আমাকে ধরতে হবে বাস কারণ আমি যাব লন্ডন থেকে আশি মাইল উত্তর পূর্বে ইপসুইচ
 
বাসে ওয়াইফাই পাবো কিনা জানিনা, তাই এয়ারপোর্টের ওয়াইফাই থেকেই ভেবেছিলাম বউকে জানিয়ে দেবো কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কানেক্ট হল না দুদিন আগে কেনা নতুন ফোন, সব সেটিংস সড়গড় হয়নি অগত্যা নতুন সিম ফোনে লাগিয়ে বেড়িয়ে এলাম আর সঙ্গে সঙ্গেই মনে হল হাতে মুখে কেউ ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিলো শুনে গেঞ্জির ওপর একটা হাল্কা জ্যাকেট ছাড়া কিছু চাপাইনি কিন্তু এখানের ঠাণ্ডা ভিজে ঠাণ্ডা
 
বাস স্ট্যান্ড সামনেই টিকিটে প্ল্যাটফর্ম নম্বর লেখা ছিল সেটাও দেখলাম একদম সামনেরটাই মালপত্র রেখে দাড়িয়ে হাত ঘষতে লাগলাম একজন মহিলা ব্যস্ত ভাবে এদিক ওদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছিল আমাকে দেখে এগিয়ে এল
 
ঠাণ্ডা লাগছে না? কোথায় যাবে?”
 
আমি হেসে জবাব দিলাম, “খুব বেশি না, তবে হাত জমে যাচ্ছে যাব ইপসুইচ
 
তোমার বাস দেড় ঘণ্টা পরে যাও যাও ভিতরে গিয়ে বস আমরা বাস এলে ডেকে দেব
 
এতক্ষণে চোখে পড়ল পাশেই একটা কাচের বিশ্রামঘর মহিলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ঢুকে পড়লাম এবার নতুন সিমের দিকে নজর দেওয়া যাক খুচখাচ চেষ্টা চলতে থাকল কিন্তু সে আর জ্যান্তই হয়না শেষে বিরক্ত হয়ে ছেড়ে দিলাম
 
দেড় ঘণ্টা কম সময় না কিন্তু তাও একসময় কেটে গেলো দূর থেকে বাসের নম্বর দেখেই উঠে দাঁড়িয়েছিলাম আগের মহিলার ডিউটি মনে হয় শেষ, একজন কমবয়সী মেয়ে দরজা ফাঁক করে ইপ্সুইচ বলে ডেকে গেলো
 
বাস এসে দাড়াতে চালক নেমে এল এক বিশালবপু মহিলা একবার টিকিট আর একবার আমার ব্যাগ দুটো দেখে নিয়ে, এক ঝটকায় একটা তুলে নিপুণভাবে বাসের পেটে চালান করে দিল দ্বিতীয়টা আমি তুলতে যাচ্ছিলাম, ইশারায় বারণ করে একইভাবে সেটাও ঢুকিয়ে দিল ভদ্রতা করে সাহায্য করতে গিয়েছিলাম বটে তবে যা ক্ষমতা, মনে হল আমার ২৩ কিলোর ব্যাগ তো কিছুই নয়, এই ১০০ কিলোর দেহটাও একইভাবে হেসে খেলে চালান দিতে সক্ষম
 

 

আমি ছাড়া আর পাঁচ ছয়জন যাত্রী নিয়ে ঘড়ি ধরে ছেড়ে দিলো বাস সাড়ে তিন ঘণ্টার যাত্রা আবার মোবাইলের সিম নিয়ে পড়লাম এবার হল অবশেষে ইন্টারনেট চালু করতেই দমাদ্দম ঢুকতে লাগল বউয়ের ওয়াটসাপ মেসেজ সাথে মিসড কলের এসএমএস সব খবর দিয়ে এবার আরাম করে বসে বাইরে তাকালাম দুইধারে সবুজ মাঠ আবার মাঝে মাঝে ছবির মতন বাড়ি কিন্তু বাস যে বড্ড আস্তে চলছে চার মাস প্রায় হতে চলল বউটাকে দেখিনি বাবা ইপ্সুইচ, তুমি আর কতদূর?

One thought on “বাঙালির বিলেত ভ্রমণ – ১ (গোড়ার কথা)

Comments are closed.