বাঙালির বিলেত ভ্রমণ – ২ (ইপ্সুইচ)

ইপ্সুইচ শহর নয় ইপ্সুইচ গ্রামও নয় ইপ্সুইচ ছোট্ট, অথচ ঝকঝকে এক মফঃস্বল বড়, নামকরা দোকান কম নেই, তবে বেশিরভাগই বন্ধ হয়ে যায় ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে এমনকি বেশিরভাগ ক্যাফেও খোলা থাকে শুধু কিছু মুদিখানা, রেস্তোরা আর পাড়ায় পাড়ায় অগুনতি পাব এখানের পাব অনেকটা কলকাতার পাড়ার চায়ের দোকানের মতন অফিসপাড়ার কাজের ফাঁকের আড্ডা হোক বা দিনের শেষে বন্ধুবান্ধবদের সাথে গুলতানি, পাবই এদের আশা ভরসা
 
সবাই জানে ইংল্যান্ড মেঘলা ছিঁচকাঁদুনি আবহাওয়ার দেশ। তবে আমার ভাগ্য ভালো ইপ্সুইচ নেমে  দেখি আকাশ বেশ পরিষ্কার। বাস ষ্টেশন থেকেই সোজা পোস্ট অফিস। প্রথম কাজ, পারমিট হাতানো। রুম্পা সঙ্গে আছে। এতদিনে এ জায়গা ওর হাতের তালু হয়ে গেছে, অতএব জিপিএস দেখে  রাস্তা চেনার ঝক্কি নেই। নিশ্চিন্তে চারপাশ গিলতে গিলতে পা চালালাম।
 
বাস ষ্টেশনের একদিকে একটা মাল্টিপ্লেক্স, অন্যদিকে দোকান, রেস্তোরা। যে কোন আধুনিক জায়গা যেমন হয়। কিন্তু একটু এগোতেই আস্তে আস্তে পালটাতে থাকল পরিবেশ। একটা পুরনো গির্জা পেরিয়ে এলাম। বেশ কিছু ছোট ছোট বাড়ী। কাঠের, ব্যাকাচোরা। দেখেই বোঝা যায় অনেক পুরনো। তবে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। বেশিরভাগেরই নিচে দোকান বা রেস্তোরা। তার মাঝে মাঝে আধুনিক ইঁটের বাড়ী। পুরনো আর নতুনের বেশ সাবলীল সহাবস্থান। নতুন বাড়ীগুলো ছিমছাম, আরম্বরহীন। চোখের আরাম দেওয়ার দায়িত্ব পুরনোদের।
 
পুরনো বন্ধ হয়ে যাওয়া একটা হোটেলের দোতলায় পোস্ট অফিস। বাইরেটা বেশ সুন্দর কারুকাজ করা। একতলা আর দোতলা নিয়ে WH Smith এর দোকান। নিচে কাগজ, পেন, পেন্সিল, ফোল্ডার, ম্যাগাজিন থেকে আরম্ভ করে আঠা, কাঁচি, স্টেপলার অবধি যাবতীয় স্কুল-অফিসের কাজের জিনিষ।  ওপরে বইয়ের দোকান। তারই একপাশে চারটে ছোট কাউন্টার পোস্ট অফিসের।
 
পারমিট হাতে আসতে লাগল মিনিট পাঁচেক। এতক্ষণে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত! বেড়িয়ে এলাম বাইরে। এই জায়গাটা ইপ্সুইচের কেন্দ্রস্থল। সোজা বাংলায় যাকে বলে টাউন সেন্টার। সোজা একটা রাস্তা, দুধারে দোকান, ব্যাঙ্ক, মল। গাড়ি ঢোকা বারণ, তাই আরামসে হেলেদুলে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে চলা যায়। চোখে পড়ল বুটস্‌ (লন্ডনে ফেলুদাতে প্রথম নাম পড়ি), সুপারড্রাগস। এগুলো মূলত ওষুধের দোকান। তবে প্রসাধন সামগ্রীই বেশি থাকে। চেনা নামের মধ্যে H&M, Marks and Spencers, Costa Coffee, Starbucks, Bodyshop। বেশ কটা outdoor sports এর দোকানএছাড়াও সস্তায় আলপিন থেকে হাতি কেনবার দোকান Poundland আর Poundworld. অনেকটা আমাদের হরেক মাল দশ টাকার মতন।
 
টাউন সেন্টার শেষ হতে শুরু হল আবাসিক এলাকা। টানা ছাঁচে ফেলা পরপর ছিমছাম সব বাড়ি। প্রধানত চার রকমের বাড়ি দেখলাম এই ইপ্সুইচে। এক, বাস স্টেশনের কাছাকাছি ও টাউন সেন্টারের  পাশে বেশ কিছু আধুনিক ফ্লাটবাড়ি। দুই, পরপর একে অন্যের সাথে জোড়া বাড়ি। দেখে মনে হবে লম্বা একটাই বাড়ি। কিন্তু ভালো করে দেখলে বোঝা যায় একটা ছাঁচের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। প্রতিটা আলাদা বাড়ি, শুধু দুটো বাড়ির মাঝের দেওয়াল একটাই। অনেকটা আমাদের উত্তর কলকাতার কিছু বাড়ির মতন। এগুলোকে বলে টেরেস হাউস। একদম দুই ধারের দুটো বাড়ি, যাদের খালি একপাশটাই জোড়া, সেগুলোকে বলে এন্ড অফ টেরেস। তিন, একসাথে জোড়া দুটো বাড়ি। টেরেসের মতনই, খালি বাড়ি দুটো। এগুলোকে সেমি ডিটাচড হাউস বলে। আর চার, একদম একলা বাড়ি বা ডিটাচড হাউস। পরে অবশ্য কিছু কটেজ আর বাংলোও চোখে পরেছে একটু বাইরের দিকে।
 
রুম্পা আমাদের জন্য যে এক কামরার ফ্লাটটা ভাড়া নিয়েছে সেটা একটা টেরেস হাউসে। এদেশ  কলকাতার মতন সমতল নয়। তাই রাস্তা হরদম উঠছে, নামছে। আমরা যেই বাড়িতে থাকব, তার সামনের রাস্তার থেকে পিছনের রাস্তা একতলা নিচু। সুতরাং সামনে থেকে যেটা একতলা, সেটা আসলে দোতলা। পাহাড়ে যেমন হয় আরকি। আমরা থাকব আসল একতলাতে, বা বেসমেন্টে। রাস্তা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে হবে। 
 
বাড়ি পৌছে প্রথম যেটা দেখে আঁতকে উঠলাম (আগের থেকে কিছুটা জানা ছিলো অবশ্য, তবে শোনা আর দেখার মধ্যে তো একটা পার্থক্য আছে, তাইনা?) সেটা হল প্রধান দরজা। মোটামুটি অর্ধেক কাঁচের। রাস্তা আর ঘরের মধ্যে শুধু একটাই দরজা, যার অর্ধেক কাঁচের! কালচার শক্ কি আর শুধু আমাদের দেশে আসলেই হয় রে পাগলা?
 
তবে ফ্ল্যাটখানা বেশ পছন্দ হল। একটা বড় ঘরের একদিকে খাট, অন্যদিকে দুটো আরামদায়ক সোফা, একটা ওয়াক ইন জামাকাপড় রাখার জায়গা। এটাও বেশ বড় এবং খুব সহজেই আমাদের স্যুটকেস, রুকস্যাক ইত্যাদির জায়গা হয়ে গেল। একটা ছোট শোবার ঘরের আয়তনের রান্নাঘর। এবং এটা যেহেতু পিছনের দিকে, দরজা খুললেই বাগান, আর না খুললেও ঘর ভরতি আলো। বাথ্রুমখানাও বেশ ভালো, তবে এদেশের যা নিয়ম। স্নানের জায়গা হোটেলের মতন একটা ঘেরা কাঁচের বাক্সতে। এবং সে বাক্সের আয়তন বড়ই ছোট। 
 
একটু হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে পরা গেল। আজ আর বাড়িতে খাওয়া দাওয়ার ব্যাপার নেই। রুম্পা আগে যেই মেয়েগুলোর সাথে থাকত, আমাদের রাতের খাবারের দায়িত্ব আজকে তারা নিয়েছে। টাউন সেন্টারের একদিকে আমাদের বাড়ি, অন্যদিকে ওদের। ধীরেসুস্তে হেঁটেও মিনিট কুড়ি বড়জোর।  মাঝে গ্রেগস থেকে একটু হট চকোলেট খেয়ে নেওয়া গেল। বেশ ভালো। প্রবাসকালে যেই কয়টা জায়গার কফি বা হট চকোলেট আমাদের ভালো লেগেছে, এটা তাদের অন্যতম। 
 
অসাধারণ দক্ষিণ ভারতীয় খাবার খেয়ে আর ভরপেট আড্ডা মেরে যখন বাড়ি ফিরছি ছোট জায়গা হিসেবে তখন বেশ রাত। পাবগুলোর আশে পাশে যদিও লোকজন ভালোই। বিশ্বাস হচ্ছিলো না গতকালই ছিলাম চেনা কলকাতার রাস্তায়। আর আজকে বিলেতের প্রথম দিনটা কোথা দিয়ে বেড়িয়ে গেলো। এভাবেই সুরুৎ করে ফেরবার দিনটাও চলে আসবে। নাঃ, কালকে থেকেই প্ল্যান করতে বসব।  কি কি করতে হবে, কোথায় কোথায় যেতে হবে, কিই বা দেখার আছে। কোনদিন ভাবিনি বটে এখানে আসব, তবে এসেই যখন পড়েছি, না ঘেঁটে কি আর ফেরা যায়?