ফোয়ারার ভেলকি
অস্ট্রিয়ার জলৎস্বর্গ। সঙ্গীতের শহর। একদিকে যেমন মোসার্টের জন্মস্থান, অন্যদিকে এই শহরেই থাকতেন “দ্য সাউন্ড অফ মিউজিক” খ্যাত ফন ট্রাপ পরিবার। তবে সঙ্গীতের পাশাপাশি এ শহর প্রাসাদেরও। মিরাবেল প্যালেস অথবা হোহেনজলৎস্বর্গ দূর্গ, কম যায় না কোনোটাই। মিরাবেল প্যালেসের বিশাল বাগানেই শ্যুট করা হয় “ডো-রে-মি” গানের শেষ অংশ।
মিরাবেল প্যালেস |
তবে আজকের গল্প শহরের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত হেলব্রুন প্যালেসের। ১৬১৩ সাল। জলৎস্বর্গের দায়িত্বে তখন প্রিন্স-আর্চবিশপ মার্কাস হোহেনহেমস। ধর্মীয় আচারবিধি ও ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা, দুইয়ের দায়িত্ব একসাথে যাঁরা পালন করতেন তাদের বলা হত প্রিন্স-আর্চবিশপ। এই মার্কাস ঠিক করলেন শহরের উপকন্ঠে গ্রীষ্মকালীন অবসর যাপনের জন্য বানাবেন এক বিলাসবহুল প্রাসাদ। দায়িত্ব দেওয়া হল ইতালিয় স্থপতি সান্তিনো সোলারিকে।
হেল্ব্রুন প্যালেস |
মার্কাস রসিক লোক ছিলেন। প্রাসাদের অতিথিদের সঙ্গে মজা করবার জন্য তিনি বাগানে প্রচুর লুকনো ফোয়ারা বসাবার পরিকল্পনা করলেন। কখন যে কোথা থেকে জল এসে কাকে ভিজিয়ে দেবে তা কল্পনাও করা সম্ভব না। যেমন পুকুরের সামনে বিশাল এক পাথরের খাবার টেবিল। তাকে ঘিরে গোল করে পাথরের বসার জায়গা। এলাহি খাওয়াদাওয়া আর পানের পর অতিথিরা যখন কিঞ্চিৎ ঢুলছেন, বসার জায়গার নিচ থেকে জল ছড়াতে শুরু করল লুকনো ফোয়ারা। বাগানের মধ্যে দিয়ে হাঁটবার সময় কখনো গাছের পিছন থেকে, কখনো কোন মূর্তির গায়ের লুকোনো কোন ফাঁক দিয়ে বা কখনো সিঁড়ির ধাপ থেকে বেরিয়ে আসবে জল।
খাবার টেবিলে ফোয়ারা |
একটা ঘরে ফোয়ারার উপরে বসানো আছে একটি মুকুট। ফোয়ারার জোর কমালে বাড়ালে জলের উপর নেচে বেড়ায় সেই মুকুট। এইভাবেই বোঝানো হয়েছে ক্ষমতার উত্থান পতন। আর আছে ২০০টি অংশবিশিষ্ট এক পাপেট থিয়েটার, যাতে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষজনের দৈনিক জীবনযাপন দেখানো হয়েছে। এই থিয়েটারের সঙ্গীত থেকে সব অংশের নড়াচড়া, পুরোটাই জলের তোড় কাজে লাগিয়ে করানো হয়। এই সব জলের কারিকুরির মধ্যে একেকটা জায়গা এমন আছে, যেখানে দাঁড়ালে কোনোদিকের কোন জলই গায়ে লাগবে না। অতিথিদের নিয়ে ঘোরবার সময় এই জায়গা ধরেই হাঁটতেন মার্কাস। তাই তিনি নিজে থাকতেন সম্পুর্ন শুকনো। আজ ট্যুরিস্টদের ঘুরিয়ে দেখানোর সময় এখানেই দাঁড়ান গাইডেরা। আর তাই, একটুও না ভিজে আজও দেখা যায়না এই মজাদার ফোয়ারার ভেলকি।
পাপেট থিয়েটার |
এত খরচা করে বানানো এই প্রাসাদের সব থেকে বিস্ময়কর বেপার হল, এখানে একটাও শোবার ঘর নেই। মার্কাস সন্ধ্যেবেলার মধ্যে ফিরে যেতেন জলৎস্বর্গ। শুধুমাত্র দিনের বেলা এসে আমোদ প্রমোদের জন্য বানানো হয়েছিল এই বিশাল প্রাসাদ।
“সিক্সটিন গোয়িং অন সেভেন্টিন” গানের প্যাভেলিয়ন |
শুরু করেছিলাম একটা গান দিয়ে। শেষ করব ওই সিনেমার আরেকটা বিখ্যাত গান দিয়ে। ফন ট্রাপ পরিবারের বড় মেয়ে লিজল ও রলফের সেই বিখ্যাত গান “সিক্সটিন গোইং অন সেভেনটিন” -এ যেই কাঁচের ঘরে তাদের নাচতে দেখা যায় মনে আছে তো? জলৎস্বর্গে শুটিং এর জন্য যেটা বানানো হয় সেটা অপেক্ষাকৃত ছোট। পরে ভিতরের শুটিং এর জন্য বড় করে আরেকটা বানানো হওয় স্টুডিওতে। ছোটটা থেকে যায় এই শহরেই। প্রথমে সেটা রাখা হওয় লিওপোল্ড প্রাসাদের ভিতরে, যেখানে ফন ট্রাপ বাড়ির লেকের দৃশ্যগুলি তোলা হয়েছিল। কিন্তু অসুবিধে হতে থাকে যখন সিনেমার ভক্তরা পাঁচিল পর্যন্ত টপকাতে শুরু করে এটা দেখবার জন্য। তখন এটা নিয়ে আসা হয় এই হেলব্রুন প্রাসাদের বাইরের বাগানে। প্রাসাদের টিকেট না কেটেই এখন দিব্যি দেখা সম্ভব এটি।