প্রথম পিয়ানো

দেশের বাইরে ঘুরতে গেলে ইংরেজি ছাড়া যেমন গতি নেই, উল্টোদিকে ইংরেজি জানা থাকলেই যে কোথাও আর অসুবিধায় পড়তে হবে না, তাও নয়। ইউরোপেই যেমন অনেক দেশেই, বড় শহরগুলোতেও, ইংরেজি একদমই না বোঝা লোকের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তবে ইউরোপে ঘুরতে গিয়ে ভাষা নিয়ে সমস্যায় পড়ার থেকে নানান মজার ও মন ভালো করা ঘটনা বরং বেশি ঘটেছে আমাদের সাথে। সেরকমই একটা ঘটনা ফ্লোরেন্সে প্রথম পিয়ানো দেখার অভিজ্ঞতা।

ফ্লোরেন্স স্টেশন
ফ্লোরেন্স স্টেশন

রোম থেকে ফ্লোরেন্সের জন্য কাকভোরের ট্রেন ধরেছিলাম ডেভিডবাবুর দেখা পাবার আশায়। শুনেছিলাম সকাল সকাল গিয়ে লাইন দিলে আগে থেকে টিকিট না কাটলেও চলে। সুতরাং বাঁচানো সম্ভব প্রি-বুকিং-এর আট ইউরো। বাস্তবেও দেখলাম তাই। আমাদের পরে পরেই প্রি-বুকড টিকিট নিয়ে আসা একটা ছেলের মিনিট পনেরো বাদেই ঢুকে পড়লাম আমরাও।

একটা সরু গলির সাদামাটা এই বাড়িটাই গ্যাল্লেরিয়ে দেল’আকাদেমিয়া

গ্যাল্লেরিয়ে দেল’আকাদেমিয়ার প্রধান আকর্ষন মিকেলেঞ্জেলোর ডেভিড হলেও এই ছোট্ট মিউজিয়ামের বাদ্যযন্ত্রের সংগ্রহও দারুণ। সেগুলো দেখার ইচ্ছে থাকলেও প্রথমেই হানা দিলাম ডেভিডের হলে। সামনাসামনি এ জিনিস দেখার অভিজ্ঞতা বর্ননা করার ক্ষমতা আমার অন্তত নেই। শুধু এটুকু বলতে পারি, অত্যন্ত চেনা এই মূর্তির আয়তন সম্পর্কে অনেকের মতন আমারও ধারনা থাকলেও, সামনা সামনি না দেখলে এর বিশালতা আন্দাজ করা কষ্টের। মাথা ঘুরে যায় সামনে থেকে ওই বিশাল মূর্তির শিরা, পেশির ভাঁজ বা উচিয়ে থাকা হাড়গুলোর ডিটেইলিং দেখলে।

ডেভিডবাবু

ভোর ভোর বেরিয়েছি। ডেভিড দেখে ভাবলাম একটু টয়লেট থেকে ঘুরেই আসি। আর সেখানে যেতে গিয়েই চোখে পরল বোর্ডটা। একটা সিড়ির পাশে রাখা। তাতে লেখা al prima piano – to the first floor. বাদ্যযন্ত্রগুলো তাহলে উপরে! চট জলদি মোবাইলে দেখে নিলাম primo মানে প্রথম। খুশি খুশি মনে উঠে গেলাম দোতলায়। প্রথম ঘরটায় সবই আঁকা। দ্বিতীয়তেও তাই। কি মুশকিল! গেলো কোথায় সেই প্রথম পিয়ানো!

দ্বিতীয় ঘরের মাঝখানে চেয়ারে বসেছিল মিউজিয়ামের একজন। তাকে ফার্স্ট পিয়ানো কোথায় জিজ্ঞাসা করতেই বিরক্ত হয়ে বলল,

“End! End! Uscita! Uscita!”

এই কদিন ইতালি ঘুরেও ইতালিয়ান শব্দ যে খুব একটা তুলতে পেরেছি তা নয়। এমনিতে আগ্রহ থাকলেও অন্য ভাষার শব্দ মনে রাখার ব্যাপারে আমি খুবই কাঁচা। তার উপর প্রথমবার নিজের চোখে রোম বা পম্পেই দেখে একটা অন্য জগতেই ছিলাম। কিন্তু যে শব্দটা একদম মনে গেঁথে ছিল সেটা হল উসিতা। মানে সোজা বাংলায় exit. লোকটার কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। যাঃ! তাহলে কি স্থায়ী প্রদর্শনী নয়? শেষ হয়ে গেছে?

নেমে আসবার আগে প্রথম ঘরের মেয়েটাকেও ভাবলাম একবার জিজ্ঞেস করে যাই। প্রশ্ন করতেই হাসি হাসি মুখে দুই দিকে হাত ছড়িয়ে মেয়েটা বলে উঠল,

“This”

এবাবা! এই ঘরেই ছিল! চোখে পড়ল না! ঝট করে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলাম। নাঃ, আঁকা ছাড়া তো কিছুই চোখে পড়ছে না। কাঁচুমাচু হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,

“Where?”

এবার মেয়েটাও থতমত খেয়ে দেখলাম চারপাশে তাকাচ্ছে। পাশের একজন ভদ্রলোক এতক্ষন মন দিয়ে আমাদের কথা শুনছিলো। এবার হো হো করে হাসতে শুরু করল। কিছুক্ষন পর হাসি থামিয়ে আমাদের হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

“Piano in Italian, floor. This is first floor. They asking for first music piano.”

এতক্ষণে বুঝলাম কি গন্ডগোলটা করেছি। ধন্যবাদ জানিয়ে কান গরম করে নেমে এলাম নিচে। পরপর দুটো লাইন লেখা মানে একটা ইতালিয়ানে আর একটা ইংরেজিতে এতো সব জায়গায় দেখে আসছি। কিন্তু মাথার মধ্যে ঘুরছিল মিউজিকাল ইন্সট্রুমেন্ট, আর তার সঙ্গে ওই বোর্ড দেখে চিন্তা ভাবনা না করে দুইয়ে দুইয়ে ছয় করে ফেলেছি।

সেই বোর্ড 🙉

পুনশ্চঃ পিয়ানোর আবিস্কর্তা Bartolomeo Cristofori-র উপর ভালো একটা প্রদর্শনী আছে এখানে। একতলাতেই, ঢুকেই বাঁদিকে। তাঁর বানানো পৃথিবীর প্রথম পিয়ানো আজ আর অক্ষত নেই। এখন অবধি পাওয়া সবচাইতে পুরনো পিয়ানোটা নিউ ইয়র্কের মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অফ আর্টে রাখা আছে। ১৭২০ সালে বারতোলোমিওর বানানো প্রথমদিকের পিয়ানোগুলোর মধ্যে একটা।